বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য অপার সম্ভাবনা ধারণ করলেও, এর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পথে এখনো অনেক বাধা বিদ্যমান। ই-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, কীভাবে প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা উদ্যোগগুলো দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং সমাধানের সম্ভাব্য পথ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হলো।
গত এক দশকে দেশে প্রায় ২,৫০০টিরও বেশি দেশীয় স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে, যা প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। বিকাশ দেশের প্রথম ইউনিকর্ন হিসেবে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, পাঠাও রাইড শেয়ারিং ও লজিস্টিকস খাতে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব ব্যবহার করেছে, শপআপ ৭৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সাপ্লাই চেইন সহজ করছে, সেবা.এক্সওয়াইজেড শহরাঞ্চলে অন-ডিমান্ড সেবা সহজলভ্য করেছে এবং স্টেডফাস্ট লজিস্টিক খাতে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি, শিখো অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করছে, Chikitsa ডিজিটাল হেলথ কেয়ারের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে, আইফার্মার কৃষকদের আর্থিক সহায়তা ও বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করছে আর ফসল প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের পণ্য সবার নাগালে নিয়ে আসছে। এরই মধ্যে Bangladrop নামে একটি বাংলাদেশি স্টার্টআপ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যেখানে আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াকে সহজ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য করার লক্ষ্য রয়েছে। অন্যদিকে, Consumer Buzz নামের একটি এআই-ভিত্তিক প্রযুক্তি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসায়িক প্রসার ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে, যার মাধ্যমে ডেটা-ড্রিভেন সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
এরপরও আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী, ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম । যেখানে ভারত ১৯তম, পাকিস্তান ৭১তম এবং শ্রীলঙ্কা ৭৬তম স্থানে রয়েছে। ঢাকার অবস্থান কিছুটা উন্নতি করে ১৫০টি সেরা শহরের মধ্যে ১৪০তম হলেও, ঢাকাকেন্দ্রিক অর্থনীতি এবং অন্যান্য অঞ্চলে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব অনেক স্টার্টআপের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বর্তমানে স্টার্টআপগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তহবিল সংকট। দেশে “ফান্ড অব ফান্ডস” অনুপস্থিত থাকায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডগুলো পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে তুলনামূলকভাবে সতর্ক। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের লাইসেন্স ও অনুমোদন সংগ্রহও উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষ কর্মীর ঘাটতি এবং বড় প্রতিষ্ঠানের উচ্চ বেতন ও চাকরির নিরাপত্তা অনেক মেধাবীকে স্টার্টআপে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখে। তদুপরি, এক্সিট স্ট্র্যাটেজির সীমাবদ্ধতা (যেমন IPO বা শেয়ার বিক্রির সুযোগ কম থাকায়) আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও হ্রাস পায়।
এই সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রথমেই একটি ‘ফান্ড অব ফান্ডস’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার, যা দেশের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহের পথ সহজ করবে। সরকারি প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করে করছাড়সহ স্টার্টআপ-বান্ধব নীতি প্রণয়ন এবং পেনশন ফান্ড ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগের সুযোগ সহজ করতে নীতিগত সংস্কার আনা উচিত। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও অবকাঠামোগত সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া, এআই, আইওটি এবং ব্লকচেইনের মতো নতুন প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ চালু করে দক্ষ জনবল তৈরি করার পাশাপাশি, স্টার্টআপগুলোর জন্য পৃথক এসএমই বোর্ড গঠন করে আইপিওর পথও সুগম করা প্রয়োজন। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ কোটি টাকা অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্টে বাধ্যতামূলক করে করছাড় বা ট্যাক্স বেনিফিট দিলে বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বেড়েই যাবে, পাশাপাশি স্টার্টআপগুলোর মূলধন সংগ্রহও সহজ হবে। কৃষি-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-প্রযুক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো সেক্টরে বেশি বিনিয়োগ করলে আন্তর্জাতিক মানের স্টার্টআপ গড়ে তোলা সহজ হবে।
বাংলাদেশকে “স্টার্টআপ নেশন” হিসেবে গড়ে তুলতে সাহসী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ দরকার। সঠিক নীতিমালা, কৌশলগত বিনিয়োগ এবং একটি সমন্বিত ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি ও সফল উদ্যোক্তা তৈরির পথ আমরা পরিষ্কার করতে পারি। ই-ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নীতিগত সহায়তা, MSME উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছি; অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর হিসেবেও স্টার্টআপগুলোকে সাপোর্ট করতে পেরেছি। এ অভিজ্ঞতা আমাকে বিশ্বাস জোগায় যে, সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে আমাদের তরুণরা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম। স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড-এর মতো উদ্যোগ জাতীয় সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে বড় ভূমিকা রাখবে। যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব। আর যথাযথ নেতৃত্বে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করবে।