আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ভারতের মুম্বাইয়ে একটি নতুন বিমানবন্দর চালু হবে। শহরটির বৃহত্তম বস্তিটির পুনর্নির্মাণ শুরু হওয়ারও কথা রয়েছে।
ওদিকে ভারতের গুজরাট রাজ্যে বিশ্বের বৃহত্তম তামা গলানোর যন্ত্রের প্রথম পর্যায়টি সম্পূর্ণরূপে চালু হওয়ার পথে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানের সীমান্তের কাছে একটি বায়ু-সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম গ্রিন-এনার্জি প্রজেক্ট। ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালাতেও একটি নতুন বন্দর হচ্ছে, যা বিশ্বের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব। শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর একটি নতুন টার্মিনালের উদ্বোধনের কথা রয়েছে, যা পার্শ্ববর্তী চীনা-পরিচালিত টার্মিনালের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
এই প্রকল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি। আদানি গ্রুপ ভারতের সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে বায়ু শক্তি, বন্দর ব্যবস্থাপনা, বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা, সিমেন্ট, রাস্তা এবং অন্যান্য পরিকাঠামো খাতে কাজ করে। অভিযোগ রয়েছে, ভারত সরকারের সমর্থন পেয়েই ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে আদানির। গৌতম আদানি হলেন প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী। বলা হয়, রকেটের গতিতে তিনি ধনী হয়েছেন। ব্যবসা শুরুর পর মাত্র কয়েক দশকে তিনি এতটাই ধনী হন যে, একপর্যায়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তাঁর অবস্থান দাঁড়ায় দুইয়ে। আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি এখন এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। তবে তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে ভারত।
গৌতম আদানি ১৯৮৮ সালে নিজের নামেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। তাঁর শুরুর ব্যবসা ছিল পণ্য রপ্তানি। একটি মধ্যম আয়ের পরিবার থেকে তিনি এসেছেন, যে পরিবারের মূল ব্যবসা ছিল কাপড়ের। ভারতের অন্যান্য শতকোটিপতিদের সঙ্গে আদানির পার্থক্য এখানেই। বেশির ভাগ ভারতীয় বিলিয়নিয়ার পারিবারিকভাবেই ধনী; অর্থাৎ, তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেয়েছেন। গৌতম আদানি এখানেই ব্যতিক্রম।
গত মাসে আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, সরকারি কাজ পেতে তিনি ঘুষ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আনা ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঘুষ কেলেঙ্কারির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমেরিকায় কাজ পাওয়ার জন্য ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছিলেন তিনি। এরই মাধ্যমে আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে টাকাও তুলেছিলেন বাজার থেকে। দাবি করা হয়েছে, ২০২১ সালের জুলাই এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। ভারতীয় কর্মকর্তাদের ২৫ কোটির ডলারেরও বেশি ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে সৌরশক্তি সরবরাহের লাভজনক চুক্তি পেয়েছিল আদানি। এই চুক্তিগুলো থেকে ২০ বছরে ২০০ কোটি ডলারের বেশি মুনাফা অর্জনের আশা করা হয়েছিল।
আদানিকে নিয়ে অবশ্য বিতর্ক এই প্রথম নয়। বরং তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক বিতর্ক উঠেছে নিজের দেশ ভারত, এমনকি বিদেশেও। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি শুধু ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না। বরং এটি ভারতের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে সন্দেহের জায়গা তৈরি করছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাধা দিতে পারে এবং বিদেশে অন্যান্য ভারতীয় সংস্থাগুলোর তহবিল সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ব্যবসা নয়, ভারতের রাজনীতির জন্যও এটি একটি ধাক্কা বটে। আদানি এবং মোদি দুজনই গুজরাট থেকে এসেছেন। মোদি ওই রাজ্যে ২০০১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখন আদানিকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাঁকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়েছে ভারতের বিরোধী দলগুলো।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমেরিকার মামলা মোদির অধীনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে। এই মামলা আমেরিকার সাথে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেহেতু আমেরিকার ক্ষমতায় এসে পড়েছেন, সেই হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো আমেরিকা এসব অভিযোগে তেমন আমলে নেবে না। তবে এই অভিযোগ মোদির ব্র্যান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করেছে। ভারত ব্যবসা বান্ধব–এমন দাবিকে আর দুর্বল করে দেয় এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্রিনবার্গ ট্ররিগ‑এর বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল পুলেসিও-বোক জানান, ফেডারেল প্রসিকিউটররা ট্রাম্পের কার্যভার গ্রহণের কয়েক মাস আগেই কাজটি সেরে ফেলতে চেয়েছেন। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ফেডারেল অপরাধের বিচারকার্যে যুক্ত কয়েক ডজন আইনজীবীকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। এবারও একই রকম হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আদানির এই পতনের শুরু হয় গত বছর থেকে। ২০২৩ সালে মার্কিন শর্টসেলার প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ এক প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিল। ওই অভিযোগে বলা হয়, কর‑স্বর্গ হিসেবে পরিচিত অঞ্চল থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ এনে আদানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। ওই অভিযোগের পর আদানির শেয়ারের দামে দ্রুত পতন শুরু হয়। একপর্যায়ে আদানির কোম্পানিগুলো ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলারের বাজার মূলধন হারায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর চলতি দফায় গত এক সপ্তাহে আদানির কোম্পানিগুলো ৫৫ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বাজার মূলধন হারিয়েছে। আদানিকে নিয়ে বিতর্ক বরং আরও জোরদার হয়েছে, যা গড়িয়েছে ভারতের পার্লামেন্টেও। এ নিয়ে সংসদে বিরোধী সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে পার্লামেন্ট অধিবেশনও মুলতবি করা হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগের পর আদানির ওপর চেপে বসেছে বেশ কয়েকটি দেশ। ফ্রান্সে আদানির ব্যবসায়ী সহযোগী টোটালএনার্জিস জানিয়েছে, ঘুষের অভিযোগের সম্পূর্ণ প্রভাব স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা নতুন বিনিয়োগ করবে না। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো বলেছেন, কেনিয়ার বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক ও প্রধান বিমানবন্দর সম্প্রসারণের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে আর আদানি গ্রুপের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দর প্রকল্পে ১৮৫ কোটি ডলার ও রাষ্ট্রমালিকানার পরিষেবা কেট্রাকোতে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ছিল আদানি গ্রুপের।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ সে দেশে আদানির কিছু বিনিয়োগ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের একটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং কলম্বোয় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। এই প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৭০ কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশ আদানির সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি পুনর্বিবেচনার প্রচেষ্টা জোরদার করছে। অস্ট্রেলিয়াতেও বর্ণবাদের অভিযোগ উঠেছে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি আদানি গ্রুপ জানিয়েছে, তারা বিদেশি বিনিয়োগ ১০ বিলিয়ন ডলার কমাবে। তবে ভারতের ভেতরে সমস্ত প্রকল্প অব্যাহত থাকবে এবং তাদের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন পর্যন্ত আদানির মামলা নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তিতে ভারতে সরকারি কর্মকর্তাদের ২০২১ সালে যে ঘুষ দেয় আদানি, তার সঙ্গে জড়িত ছিল অন্ধ্র প্রদেশ সরকার। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাজ্যটির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডি। মামলাটি ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রকদের ওপরও নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া আদানি সম্পর্কিত ২৪টি তদন্তের একটি প্রতিবেদন শিগগিরই প্রকাশ করবে বলে জানা গেছে। আদানি বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছে কিনা, তা নিয়ে এখন ভারতে নতুন তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও আদানির কেলেঙ্কারি বাইডেন প্রশাসনের শেষ সময়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। নিউইয়র্কে এক শিখ কর্মীকে হত্যার চেষ্টায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ এরই মধ্যে এ সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা সম্প্রতি রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার জন্য ভারতকে চাপ দিয়েছেন। বিজেপির এক মুখপাত্র বলেন, ‘বিদেশ থেকে ভারতের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সব ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমাদের জোর দিয়ে বলা উচিত যে, আমরা আমাদের নিজস্ব আইনি ব্যবস্থা অনুযায়ী কাজ করব, তাদের নয়।’
আদানি এবং মোদি হয়তো এবারও বিতর্ক থেকে বেঁচে যাবেন। যেমনটা তাঁরা এর আগেও অনেকবার গেছেন। কিন্তু ভারতের ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার, তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে।